মৎস্যগন্ধা

ফেব্রুয়ারির শেষের ইলশেগুঁড়ি ধোঁয়াশায় ডুবে আছে গ্রাম। অনুকূল জানা স্মৃতির ভারে নুয়ে, আমুদিনীর মুখে খুঁজে ফেরে হারানো দিনগুলোর আলো।

- সায়ন্তনী বসু চৌধুরী

ফেব্রুয়ারির শেষ। আমুদিদের গোটা উঠোন ইলশেগুঁড়ির মতন গুঁড়ো গুঁড়ো কালোয় ঝাপসা। কাঁজিরঙের চাদরখানা গাঁয়ের চারটে দিককে আষ্টেপৃষ্ঠে মুড়ে রেখেছে এখনও। পাড়াপ্রান্তের ঢ্যাঙা তাল-নারকেল, মাঝারি বাড়ের খেজুর-ছাতিম, গ্যাঁড়াগুঁড়ি বনপালার সুখনিদ্রা ফালাফালা করে পুবের দিকচক্রবাল বেয়ে পা টিপেটিপে নামছে রাঙা আলো; এমনই ধীরলয়ে তার পয়মন্ত চলন যেন লাজুকলতা বউখানি!

প্রতিদিন এমন বিহানেই মাঠের পথে রওনা দেয় অনুকূল জানা। আকাশ জ্বলজ্বলে হলে এসে পড়বে কালীপদ আর তার ভায়রাভাই। তরুণ হাতের স্পর্শে চাষকাজে গতি লাগবে। শীর্ণ হাত দু'টিকে বিরাম দিয়ে আলে বসে বিড়িতে সুখটান দেবে অনুকূল। মলিন গায়ে মেখে নেবে প্রভাতী রং। বাতাস তার কানেকানে বলে যাবে, ‘বিয়ার বয়স ত অইল, মায়্যাডারে আর কয়দিন খুঁটায় বাইন্ধ্যা রাখবা?” অনুকূলের বউ নবমী গত হয়েছে বছর চারেক আগে। কাঁচা বয়সে ঘুমন্ত মেয়েটাকে কোলে নিয়ে মাটির দাওয়ায় বসে নবমী প্রায়ই বলত, ‘বুইঝনি আমুর বাপ, হেমন সন্দর মায়্যার লইগ্যা চাইন্দপানা পোলা আওন লাগব!” অনুকূল অসন্তোষ প্রকাশ করে রোদেপোড়া ফাটাফাটা আঙুল চাপা দিত তার ঠোঁটে। ‘পোড়ারমুখী দ্যাহস না, মায়্যাডা আমাগো ঘুমায়! মায়ের নজরে বিষ! জানস না?” পরক্ষণেই ঘুমন্ত শিশুসমেত সোহাগ করে নবমীকে বুকে টেনে নিত অনুকূল। অনুকূলের স্মৃতিচারণার শিথিল সময়ে কিংবা ভাবনার সমুদ্দুরে স্রোতের বিপরীতে সাঁতার কাটার মুহূর্তে যখন তার গা-ঘেঁষে সকালের জলযোগে বসে শেখরকালীপদ-প্রকাশ, ফন্দি করেই অনুকূলকে তারা মধুমাছির মতো ছেঁকে ধরে। ‘আইজ তোমার ছাড়ন নাই কাকা। আইজ বাঘের গল্প কওন লাগব!'

প্রথমটায় গায়ে মাখে না অনুকূল। পোলাগুলোকে হুসহাস করে কাকের ছায়ের মতো তাড়ায়। শেষটায় তারা নাছোড় জেদ ধরলে মানুষটা মুখ খুলতে বাধ্য হয়। “বিবিমার দয়ায় খাইয়াপইর‍্যা বাইচ্যা আছস, যহন তহন ত্যানারে স্মরণ করা ক্যান রে বাপ? তরা বাপ -কাকার কওন মানস না দেইহ্যাই ত অ্যাক্সিডেন বাড়তাসে।' জোয়ান মদ্দরা মজা পায়। বাঘের মুখ থেকে বেঁচে ফেরা অনুকূলকাকার অভিজ্ঞতা শোনার লোভ তাদের চোখে হলদে আগুনের মতো জ্বলে। মনে মনে বনবিবি, বাবাগাজি আর দক্ষিণরায়কে পেন্নাম ঠুকে অনুকূল বলতে শুরু করে, “হেই কর্তা সিলেন গিয়া সাইত ফুট লম্বা! মাতাখানাই ত হেই হ্যাত্ত বড়।’