গলি

নীলিমা মিত্র, একজন মনোবিদ, হাতে ধরা দামি মোবাইল ফোনটি থেকে চোখ তুলে তাকালেন এক দম্পতির দিকে। স্বামী-স্ত্রীর অস্বাভাবিক পরিস্থিতি দেখে, নীলিমা তাঁদের সমস্যা জানতে চাইলেন। মানসিক সমস্যা বা আবেগের জটিলতা সমাধান করতে তিনি কথা বলেন, তবে কখনও পেশাগত দৃষ্টিভঙ্গি হারান না। এই পরিস্থিতি তাঁর জন্য অস্বস্তিকর হলেও, তিনি তাঁর নিয়ম এবং পেশাদারিত্ব বজায় রেখে ক্লায়েন্টের সমস্যার মূলে পৌঁছানোর চেষ্টা করেন।

- সোমজা দাস

হাতে ধরা লেটেস্ট মডেলের দামি মোবাইল ফোনটা থেকে চোখ তুলে তাকালেন নীলিমা মিত্র। সামনে একটি অল্পবয়সি বউ। সঙ্গের চাষাড়ে চেহারার লোকটা যেতারস্বামী সেটা আলাদা করে বলে দেওয়ার দরকার হয়না। ‘বসুন।’ কণ্ঠস্বরে অতিরিক্ত ওজন আরোপ করে বলেন নীলিমা। ঠোঁটে ভাসিয়ে রাখেন মাপা হাসির টুকরো। এটা তার পেশার অঙ্গ, দীর্ঘ অধ্যবসায়ে রপ্ত করতে হয়েছে। এতে রোগী বা রোগিণীর মধ্যে তাঁর প্রতি সম্ভ্রম তৈরি হয়। তাঁরা আশ্বস্ত বোধ করেন।

নীলিমা মিত্র মনোবিদ। তাঁর ক্লায়েন্টদের ঠিক রোগী বলা যায় না। কারণ ওষুধ দেওয়া বা চিকিৎসা তাঁর কাজ নয়। নীলিমা শুধু কথা শোনেন। শুনতে শুনতেই সামনের মানুষটির মনের গভীরে লুকিয়ে থাকা সমস্যাটা বুঝে নেন। কথা বলেন। কথার পৃষ্ঠে কথা, তার উপর কথা। পুরোটাই নিক্তিতে মাপা, সুন্দর। প্রথাগত ডাক্তার না হয়েও নিজেকে ডাক্তার ভাবতে পছন্দ করেন নীলিমা। মনের মধ্যে যে জটিলতা জন্ম নেয়, ঘুণপোকার মতো ভেতর থেকে কুরে কুরে শূন্য করে ফেলে মানুষকে, তা রোগ নয়ই বা কেন! এই যে নীলিমার ক্লায়েন্টরা তাঁর উপর ভরসা করেন, তাঁকে দেখলেই ওদের চোখেমুখে আলো জ্বলে ওঠে, নীলিমা মিত্রের চেম্বারে সমস্ত দুঃখ, মানসিক অস্থিরতা, দ্বিধা-দ্বন্দ্ব নামিয়ে রেখে শান্ত হয়ে ঘরে ফিরে যান তাঁরা, এ চিকিৎসা নয়!

তবে এই মুহূর্তে সামনের দম্পতিকে দেখে ভুরুটা সামান্য কোঁচকাল নীলিমার। তাঁর সময়ের যা দাম, তা মধ্য বা নিম্নবিত্তের নাগালের মধ্যে নয়। আধ ঘণ্টার কাউন্সিলিং-এর জন্য হাজার টাকা ভিজিট। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই একটা সিটিংএ কাজ হয় না। প্রক্রিয়াটা দীর্ঘসূত্রী। এদিকে তাঁর নবাগত ক্লায়েন্টের পোশাক-পরিচ্ছদ দেখে মনে হয় না তাদের বিত্ত বা সামাজিক অবস্থান নীলিমা মিত্রের চেম্বারে ঢোকার অনুমতি দেয়। তাই অবাক হয়েছেন নীলিমা। কিন্তু সেটা বাইরে প্রকাশ করা চলে না। তাই হাসিটা ঠোঁটে আলগোছে ঝুলিয়ে রেখেই জিজ্ঞাসা করলেন, ‘বলুন, কী সমস্যা?”

বউটির মিষ্টি মুখখানায় ধূসর ছায়া, রোগ বা শোকের। পরেরটি হওয়ারই সম্ভাবনা বেশি। সস্তার সিন্থেটিক শাড়ি পরনে। সঙ্গে জ্যালজেলে রং-ওঠা ঢলঢলে সুতির ব্লাউজ। আঁচল দিয়ে গা ঢেকে রেখেছে। বর্ষার জলভরা মেঘের মতো নরম শ্যামল গায়ের রং। সিঁথিতে মেটে সিঁদুর মোটা করে লেপা। দৃষ্টিতে শঙ্কিত ভাব। এরকম জায়গায় আগে কখনও আসেনি, বোঝাই যাচ্ছে।