অসামান্য এক পরম্পরা

বিখ্যাত শিক্ষকরা ছাত্রদের মধ্যে এমন চিন্তা-চেতনার বীজ বুনেছিলেন, যার ফলে তাঁরা পরে হন মহিরুহ | পাশ্চাত্যের এমন কয়েক জন খ্যাতনামা ছাত্র-শিক্ষককে নিয়ে লিখেছেন বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়

- বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়

বিজ্ঞানী রিচার্ড ফাইনম্যান তাঁর 'ফাইনম্যান লেকচারস অন ফিজিক্স'-এ বলেছিলেন, “বিজ্ঞানের সমস্ত জ্ঞান যদি ধ্বংস হয়ে যায় কোনও সর্বগ্রাসী প্লাবনে আর পরবর্তী প্রজন্মের জন্য বেঁচে থাকে একটাই মাত্র বাক্য, তা হলে সেই বাক্যটি হবে এই যে, সব কিছুই পরমাণু দিয়ে তৈরি। নিরবচ্ছিন্ন গতিতে ঘুরে বেড়ানো সেই সব ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কণারা পরস্পরকে আকর্ষণ করে, যখন অল্প-অল্প দূরে থাকে। আবার প্রতিহত করে, যখন তাদের একটাই মণ্ডে পরিণত করার চেষ্টা হয়। ” পাশ্চাত্যের ছাত্র-শিক্ষক ইতিহাসের দিকে তাকালে মনে হয় যে ওই পরস্পরকে একই সঙ্গে আকর্ষণ এবং প্রতিহত করার শক্তি ওখানকার ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের ক্ষেত্রেও সত্যি। ভারতীয় পরম্পরায় যেমন একলব্য তাঁর গুরু দ্রোণাচার্যের নির্দেশে নিজের ডান হাতের বুড়ো আঙুল কেটে দিয়েছিল অক্লেশে কিংবা আরুণিউদ্দালক যে ভাবে তাঁর গুরু ধৌম্যর নির্দেশ পালনের জন্য নিজের শরীর মাটিতে বিছিয়ে বাঁধের ভূমিকা পালন করেছিল বন্যা আটকাতে, ইউরোপ বা আমেরিকায় ঠিক তেমন নজির মেলে না। পাশ্চাত্যের ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক তাই ফুলের সৌন্দর্যে পাগল হয়ে ছুটে আসা নয়; বরং বিজ্ঞানীর দৃষ্টিতে ফুলকে পর্যবেক্ষণ করে তার রং-রূপ-বিন্যাসকে উপলব্ধি করার যাত্রা। খুঁজলে পরে দ্রোণ আর অর্জুনের সমীকরণ ইউরোপেও হয়তো মিলবে, যেখানে শিক্ষক তাঁর বিশেষ কোনও ছাত্রের প্রতি অতি মাত্রায় দুর্বল। কিন্তু তার বিপরীত উদাহরণ আরও অনেক বেশি পাওয়া যাবে, যেখানে শিক্ষক এবং ছাত্র দু'জনেই মনে রাখেন যে, তাঁদের জীবন, এক জনকে কেন্দ্র করেই পাক খায় না। আরও এক বিখ্যাত বিজ্ঞানী নিলস বোরের জীবনের একটি কথা বললে, ব্যাপারটা বেশি স্পষ্ট হবে হয়তো। ‘থাটি ইয়ার্স দ্যাট শুক ফিজিক্স' নামের বইতে নিলস বোর কী রকম রাত বারোটায় পাঁচিলের খাঁজে খাঁজে পা রেখে একটা ব্যাঙ্কের দোতলা পর্যন্ত উঠে গিয়েছিলেন, তা শব্দে আঁকা আছে। ওই একই বই থেকে আমরা এ-ও ইঙ্গিত পাই যে, ব্যাপারটা নিয়ে বোরের কিছু ছাত্রছাত্রীও হাসাহাসি করেছিল। যদিও তারা জানত যে, অমন পাগলামি প্রতিভাবানকেই মানায়। কিন্তু প্রতিভাবানকে নিয়েও হাসি-মজা হতে পারে, যাঁর কাছে শিখছি, তাঁকে অবিরত প্রশ্নও করতে পারি, এটাই পাশ্চাত্যের শিক্ষক-ছাত্র সম্পর্কের মূল স্তম্ভ। শিক্ষককে ‘গুরু' বলে মানতে হবে, তাঁর প্রতিটি কথায় ঘাড় হেলিয়ে সায় দিতে হবে, এমন কোনও বাধ্যবাধকতা নেই সেখানে। একেবারে প্রাচীন গ্রিসে যদি ফিরে যাই