ছবির নিসর্গ

কত্তামা চোখে আগুন ঢেলে বললেন, “যা তো এখান থেকে। শুধু ছুকছুক করবে।” বড়বৌকে বললেন, “দরজাটা বন্ধ কর তো মা। এই সব আর নিজের কাছে রাখব না। কার্শিয়াং থেকে এসে সব লকারে দিয়ে দেব।”

- তিলোওমা মজুমদার

দিন যত এগিয়ে আসছে, ততই ছবির বুকের মধ্যে ঘনিয়ে উঠছে ভয় ও উদ্বেগের পাঁশুটে ধোঁয়া। বাইরে দেখাচ্ছে যেন কিছুই না। জগতের সমস্ত উপভোগ্যতায় সে অভ্যস্ত, ঘরের বাইরে পা দিয়ে সকল সপ্রতিভ অভিজ্ঞতা তার করায়ত্ত। অথচ কত্তামা যখন বললেন, “ছবি, তুইও যাচ্ছিস কিন্তু”, সে গালে হাত দিয়ে থপাস করে মেঝেতে বসে পড়েছিল, নিজেই শুনতে পাচ্ছিল নিজের হৃদিযন্তরের ডুগডুগি। কত্তামা বিরক্ত হয়ে বলেন, “ওমনি বসে পড়লি কেন? বড় ঢং করিস। যা, শুকনো কাপড় তুলে এনে ডাঁই করে রেখেছিস, ভাঁজ কর গে।” “মা গো মা, আমাকেও নে যাচ্ছ? ওকেনে টিবি আছে তো? ও মা গো, কুসুমের মাস, ছোটবৌয়ের কান্না, জুমুরের জুমকো — মিস কত্তে পারবনি।” পৃথুল দেহখানিতে হিল্লোল তুলে, গ্রীবা বঙ্কিম করে সে কত্তামায়ের দিকে চাইল। কত্তামা বলেন, “ওখানে লোকে যায় পাহাড় দেখতে, টিভি দেখতে যায় কেউ!” “ও মা, ছিরিয়াল তো হবে নাত্তিরে। ত্যাখান তুমি কোন পাহাড় দেকবে?” “ওঃ, জ্ঞানের নাড়ি তো টনটন করছে!

বড়বৌমা আসবে একটু পরে। জিজ্ঞেস করিস টিভি আছে কিনা।” “না বাবা না। সে তুমি জিগাসি কোরো। আমার ভয় নাগে।” সে ঠোঁট টিপে, গ্রীবা দুলিয়ে কাপড় ভাঁজ করতে যায়। এখুনি সব গুছিয়ে না-রাখলে বড়বৌ নানা কথা বলবে। বড়, ছোট কোনও বৌকেই পছন্দ করে না ছবি। বড্ড ডাঁট ওদের। এসেই কাজের খুঁত ধরবে—এটা হয়নি কেন, ওটা করিসনি কেন। এসে তো শুধু শাউড়ির সঙ্গে আড্ডা দেবে আর হাহা হিহি করবে। একদিনও কেউ মাথায় তেল দিয়ে দেয়? পিঠে ময়ছার লাগিয়ে দেয়? সে সবই কে করে—ছবি। তাকে ছাড়া কত্তামার একদণ্ড চলে? অথচ বৌরা এসে এমন করে শাউড়িকে ঘিরে থাকে আর ছবিকে পরের পর ফরমায়েশ দেয়, ছবির মনে হয়, সে যে এ বাড়ির মাইনে করা পরিচারিকা মাত্র, সেইটি বুঝিয়ে দেওয়াই এদের উদ্দেশ্য। কত্তামা কিন্তু ওইরকম না। বকাঝকা করেন, কিন্তু ছবিকে ভালবাসেন যেন পেটের মেয়ে।