কৃষ্ণগহ্বর

দুটি জীবন, দুই আলোকবর্ষ দূরের ভেসে থাকা কণা— না মিললেও এক মুহূর্তে ছুঁয়ে যায় হৃদয়ের গভীরতম অনুভূতিকে। এ গল্প মহাকাশের নয়, তবুও যেন এক নিঃশব্দ ছায়াপথে আবর্তিত দু’জন মানুষের অস্ফুট সংলাপ।

- তনু শ্ৰী দাস

গল্পটা কোনও মহাকাশ বিজ্ঞানের গল্প নয়। তবুও যেন অনেক দূরের সেই মহাকাশেরই গল্প। স্থান কালের বিশালত্বের মধ্যে দুটো মানুষ ভাসছে, ভাবছে পরস্পরের কথা, তবু কাছে আসতে পারছে না— এটা যেন ঠিক এই চেনা পৃথিবীর গল্প নয়। অনন্ত শূন্য যে মহাকাশ, সেই মহাকাশে প্রতিটি বস্তুখণ্ড নিজের মতো ভেসে থাকে। এদের দু'জনের মতোই। বহু আলোকবর্ষ পর হয়তো কোনও হাইড্রোজেন, হিলিয়ামের প্লাজমা দিয়ে গঠিত দু'টি ক্ষুদ্র কণা পাশাপাশি আসে, তার পর আর কখনও আসে না। হারিয়ে যায়। তাদের গল্প কেউ মনে রাখে না। অপার বিশালত্বের মধ্যে ক্ষুদ্রকে কে-ই বা মনে রাখে? তাদের গল্পটা শুরু হয়েছিল, এই রকম কথোপকথনের মধ্য দিয়ে। “আমি জানি আপনার চলে যেতে ইচ্ছে করছে। বিশ্বাস করুন, যে কাজে এসেছি সেটা এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ইচ্ছে আমারও নেই। কিন্তু এসেই যখন পড়েছি, আর-একটু বসে গেলেই হয়।” প্রতিম এবার একটু থমকে গেল। মেয়েটা থট রিডার নাকি? চলে যেতে ইচ্ছে তার যথেষ্টই করছিল। কিন্তু নিখাদ কৌতূহলে বসে পড়ল। তাছাড়া হুট করে চলে যাওয়া চূড়ান্ত অভদ্রতা হবে।

মেয়েটি যখন রেস্তরাঁর সুইং ডোর খুলে ঢুকল তখনই ভ্রু কুঁচকে গিয়েছিল প্রতিমের। সাধারণ তাঁতের শাড়ি, চুলে একটা আলগা খোঁপা, কপালের সামনে কিছু অবাধ্য চুল উড়োউড়ি দাপাদাপি করছে। কানে একটা সাদা পাথরের সস্তা দুল, হাতে একটা বেশ পুরনো রিস্টওয়াচ। কোনওরকম প্রসাধনের বালাই নেই। হতে পারে মেয়েটি বেশ আটপৌরে, কিন্তু যে উপলক্ষে তাদের এখানে মোলাকাত, তাতে একটু ফিটফাট হয়ে আসাই দস্তুর। “না না, উঠে যেতে ইচ্ছে করবে কেন? দাঁড়ান ওয়েটারকে ডাকি।”

প্রতিম নিজেকে সামলে নিল। এখানে বিরক্তি প্রকাশ করবে না সে। ভদ্র ভাবে আজকের সন্ধ্যাটা কাটিয়ে শিমুলদাকে জানিয়ে দেবে পাত্রী পছন্দ হয়নি। প্রতিমের মা-বাবা গত হয়েছেন। প্রথম জীবনে প্রতিমদের অবস্থা বিশেষ ভাল ছিল না। বাবার ছোট একটা ব্যবসা ছিল। আদাজল খেয়ে লেগে থেকে প্রতিম আজ ব্যবসাটা দাঁড় করিয়েছে। এখন আর প্রতিমের চেহারায় অতীতের দুঃখকষ্টের ছাপ নেই। দামি পারফিউম আর ব্লেজারে সুসজ্জিত তরুণ প্রতিম রীতিমতো দর্শনধারী। তবে বয়সটা তো কারও থেমে থাকে না। এই জুলাইতে আটত্রিশ হল।