বিনির সংসার

অদ্ভুত বলা হয়, হাসাহাসি হয়, তবু আমার নিজের মতো থাকতে ভালো লাগে। আমাদের এই পরিবারের গল্প ভালোবাসা আর বোঝাপড়ায় বাঁধা এক বিশেষ বন্ধনের সাক্ষী।

- মোনালিসা চন্দ্ৰ

আমার ফ্যামিলিটাকে লোকে বলে অদ্ভুত। শুধু বলে না, হাসাহাসিও করে। ওদের চোখে আমি নাকি খুব পিকিউলিয়ার ক্যারেক্টার, হাসাহাসির পাত্র। তবে লোকে কী বলল না বলল তাতে আমার কিস্যু যায় আসে না। ওদের চোখে আমি যেমন অদ্ভুত, আমার চোখে ওরাও তেমনই অদ্ভুত। আমি শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে বিশ্বাসী। তোমরা তোমাদের অদ্ভুতত্ত্ব নিয়ে থাকো, আমাকে আমারটা নিয়ে থাকতে দাও। আগ বাড়িয়ে নিজেদেরটা আমার ঘাড়ে চাপাতে এসো না, তাহলেই হল।

আমাদের পরিবারের সিনিয়ারমোস্ট মানুষটি, যাঁকে আমি মাসিমা বলে ডাকি, তাঁর হাতেই এ সংসারটা তুলে দিয়েছি আমি। মাসিমাকে শুধু যে এ বাড়ির কর্ত্রী বলে মানি তা নয়, মানি আমার মা বলেও। আমার নিজের মা বছর দশেক হল স্বর্গে গিয়েছেন। সেই মায়ের যাবতীয় মা-মা ভাবগুলোর সঙ্গে এক্সট্রা আরও বেশ ক'টা রেয়ার কোয়ালিটি নিজের মধ্যে ধারণ করেন এই মাসিমা। অথচ সেই কোয়ালিটিগুলোর সন্ধান জগতের আর কেউ পেল না। কেন যে পেল না সেই কথাটাই ভাবি। কম লোকজন তো ছিল না মাসিমার চারপাশে! তাদের দয়ায় একটা সময় মানুষটার জীবন নরক পর্যন্ত হয়ে উঠেছিল। নিজের কাছে তাই শপথ করেছি আমি, যতদিন বাঁচবেন, পরিপূর্ণ আনন্দে আর নির্বিঘ্নে রাখার চেষ্টা করব মাসিমাকে। অফিস থেকে ফিরে চায়ের কাপ হাতে আমি যখন মাসিমার পায়ের কাছটিতে এসে বসি আর মাসিমা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দেন, তখন সারা শরীরে যে শান্তিটা টলটল করে আমার তার কথা কাকে বোঝাব? মাসিমার রাবণের গুষ্টির কারও কোনওদিন মনে হয়নি ওঁর ওই জাদু আঙুলগুলোর সামনে নিজেদের মাথাটা পেতে দিই। উল্টে, তারা সকলে এককাট্টা হয়ে উঠেছিল মানুষটাকে বাড়ি থেকে তাড়াতে। আজ ওই লোকগুলোরই নাকি আমাকে পিকিউলিয়ার মনে হয় ! হাহ্ ! সন্ধের এই সময়টায় আমি আর মাসিমা আরও একজনের সঙ্গ কামনা করি। ও এলে আমাদের আড্ডাটা আরও জমে, আরও নিটোল হয়। তবে এ বাড়িতে তাকে আনতে একটা সময় বহু কাঠখড় পোড়াতে হয়েছিল আমাকে। এ বাড়ির দরজা পর্যন্ত ওর আসা দেখে তখন মনে হতো যেন কাঁটার ওপর দিয়ে হেঁটে আসছে। লোকজনের বাঁকা হাসি আর তেরছা চাউনিগুলো ঢালের মতো আটকাতে আটকাতে বাড়িতে আনতে হতো তখন সুবীরকে। তবে লজ্জা সঙ্কোচের মতো জঞ্জালগুলো ঝেড়ে ফেলে নিজের নামের মর্যাদাটা শেষ পর্যন্ত রেখেছে সুবীর। বাঁকা হাসি হাসনেওয়ালারাই বরং হেসে হেসে ক্লান্ত হয়ে হাসা থামিয়েছে।