রাগ অকল্যাণ

অলোক সান্যালের শেষযাত্রায় উপস্থিত ছিলাম আমরা মাত্র ছ'জন, গুরুর অন্তিম মুহূর্তে শ্মশানের নিস্তব্ধতা যেন জীবনের শেষ সুর হয়ে বাজছিল। অলৌকিক এক সুরের টানে শুরু হওয়া যাত্রার পরিণতি ছিল নিঃসঙ্গতা, যন্ত্রহীনতা, আর এক অচেনা অন্ধকার।

- সৈকত মুখোপাধ্যায়

• গিয়েছিলাম উত্তরপাড়ার শিবতলা শ্মশানঘাটে, আমার সেতার শিক্ষার গুরু অলোক সান্যালের শবযাত্রায়। আমরা যারা তাঁর প্রথমদিকের ছাত্র তারা গুরুজিকে অলোকদা বলেই ডাকতাম। উনি সেই সম্বোধনটাই পছন্দ করতেন। মাত্র ছ'জন মানুষ আজ অলোকদার শেষযাত্রার সঙ্গী ছিলাম। ওঁর মেয়ে মুনিয়া আর জামাই প্রবুদ্ধ তো ছিলই। তাছাড়া ছিলাম আমরা তিন শিষ্য, যে তিনজন ওঁর অসুস্থতার বিষয়টা জানতাম— আমি, সুব্রত আর রাতুল। আর ছিল সান্যাল বাড়ির বহুদিনের গৃহভৃত্য, মনোহর। আসলে জীবনের শেষ দুটো বছরে অলোকদার সঙ্গে কারও যোগাযোগ ছিল না। যোগাযোগ রাখার মতো অবস্থাতেই ছিলেন না তিনি। মৃত্যুর খবরও আমরা কাউকে দিইনি। দিলেই অনেকের অনেক প্রশ্নের উত্তর দিতে হতো। উত্তরগুলো কারও পছন্দ হতো না। সেইজন্যেই এত বড় মাপের একজন মানুষের শেষযাত্রায় শ্মশানবন্ধুর সংখ্যা মাত্র ছয়। চৈত্র মাস, বিকেল পাঁচটা। শিবতলা শ্মশানঘাটের চুল্লিতে যখন অলোকদার শরীরটা সমর্পণ করা হল তখন গঙ্গার ওপাড়ে সূর্যের গায়ে সবে কমলা রঙের আভাটুকু লেগেছে। দাহ শেষ হতে অন্তত পঁয়তাল্লিশ মিনিট তো লাগবেই। আমরা পাঁচজন ঘাটের সিঁড়িতে গিয়ে বসলাম। মনোহর গেল শ্মশানের বাইরে জিটি রোডের লাগোয়া চায়ের দোকান থেকে চা-বিস্কুট আনতে। বসে বসে দেখছিলাম সূর্যটা ক্রমশ লাল হতে হতে দিগন্তের দিকে নেমে যাচ্ছে। প্রাথমিক শোকের হাহাকার সামলে সকলেই তখন অনেক শান্ত হয়ে এসেছি — যাকে বলা হয় “শ্মশানের শান্তি'। মুনিয়া আমার পাশেই বসেছিল। এখন নতুন প্রজন্মের সেতারিদের মধ্যে অনুরাধা সান্যাল বেশ সম্মাননীয় এক নাম।

কিন্তু পঁচিশ বছর আগে যখন উত্তরপাড়া খেয়াঘাটে ওদের বাড়িতে বাজনা শিখতে যেতাম তখন অনুরাধা অর্থাৎ মুনিয়া পাঁচ বছরের খুকি। বারান্দার রেলিং-এর মধ্যে পা গলিয়ে বসে বাগানের পাখপাখালির সঙ্গে গল্প করত। ওড়নাটা আঙুলে জড়াতে জড়াতে মুনিয়া স্বগতোক্তি করল, ‘এত ভালো মানুষটা, এত কষ্ট পেয়ে গেল কেন কে জানে! এই হতচ্ছাড়া অসুখটা যদি না হতো তাহলে বাবা আরও অনেকদিন বাঁচত। পঁয়ষট্টি কি একটা চলে যাবার বয়স?'